একটা আস্ত শহরের সব মানুষ খুকখুক করে কেশে বেড়াচ্ছে, তাও কারোর কোন চ্যাতব্যাত নাই! এইটা নাকি ‘সিজন চেঞ্জ’ হলে একটু আধটু সবারই হয়!
জি না, হয় না। খুকখুক কাশির সাথে ঋতু পরিবর্তনের সম্পর্ক নাই। সম্পর্ক আছে বায়ু দূষণের। সারা দুনিয়াতে সবখানেই ঋতু পরিবর্তিত হয়, সবাই ঢাকাবাসির মত খুকখুক করে কেশে বেড়ায় না। সমস্যা এই শহরের বাতাসে, ঋতুতে না।
রুটিন মিথ বাস্টিং
১। “বায়ু দূষণের কারণ গাড়ি” [ভুল!]
ঢাকার (ক্ষুত্রকণা থেকে ছড়ানো) বায়ু দূষণের মাত্র ২০ ভাগেরও কম আসে গাড়ি থেকে। ঢাকায় কি নিউ ইয়োর্কের চেয়ে বেশি গাড়ি? যদি না হয়, তাহলে ঢাকার বাতাস নিউ ইয়োর্কের চেয়ে খারাপ কেন? কারণ বায়ু দূষণের বেশিরভাগটা আসে অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত নির্মাণ শিল্পর সাথে জড়িত কর্মকাণ্ড ও কল কারকাখানা থেকে।
২। “কী করা যাবে? বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।” [ভুল!]
বেইজিঙের দূষণের খবরের কথা মনে পড়ে? সমস্ত শহর ধূসর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে স্বাভাবিক সকল কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল? বেইজিঙের এখন কী অবস্থা? আর শোনা যায় দূষণের কথা? ২০১৩ এর তুলনায় ২০২১ এ বেইজিঙের বায়ু দূষণ অর্ধেকে কমিয়ে আনা হয়েছে। তার মানে প্রবল দূষণ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। চিন তা করে দেখিয়েছে। এবার চিন্তা করে দেখুন কীভাবে কমলো চিনের রাজধানীর মত বিশাল এবং জটিল শহরের বায়ু দূষণ?
বেইজিংয়ের নির্মাণ শিল্প থেকে দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা
বেইজিং গত এক দশকে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছিল বায়ু দূষণ কমানোর জন্য। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পরিবহণ, নির্মাণ শিল্প থেকে বায়ু দূষণ কমানোর জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল। এবং তাতে যথেষ্ট সাফল্য এসেছে। কিন্তু ঢাকার এই মুহূর্তের মূল সমস্যা যেহেতু নির্মাণ শিল্প থেকে উৎপন্ন দূষণ, তাই এই খাতে বেইজিঙের উদ্দগগুলোর দিকে তাকানো যাক।
নির্মাণ খাত ছিল বেইজিঙে বায়ুবাহিত কণিকার (PM10 এবং PM2.5) একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল:
১. ধুলা নিয়ন্ত্রণের বিধি
- আবরণ বাধ্যতামূলক: নির্মাণস্থলগুলোতে মাটি, নির্মাণ সামগ্রী এবং রাবিশের ডিবিতে আবরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল যাতে ধুলা না ছড়ায়।
- পানি ছিটানো এবং ধুলা দমনকারী রাসায়নিক: ধুলো নিয়ন্ত্রণে নির্মাণস্থলে পানি ছিটানো এবং ধুলা দমনকারী রাসায়নিক ব্যবহারের নিয়ম চালু করা হয়।
- ঘেরা স্থানে নির্মাণ: ধুলো ছড়িয়ে পড়া রোধে নির্মাণস্থলের চারপাশ ঘিরে দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
২. যন্ত্রপাতি উন্নয়ন
- যন্ত্রপাতির নির্গমন মানদণ্ড: নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সর্বচ্চ দূষণের মান বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। অধিক দূষণকারী যন্ত্রপাতির আমদানি ও ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছিল।
- কম দূষণকারী যন্ত্রপাতি: পুরানো, উচ্চ-ধোঁয়া-নির্গমনকারী যন্ত্রপাতির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক এবং শক্তি-সাশ্রয়ী নির্মাণ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হয়।
৩. উন্নত পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োগ
- রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণ: নির্মাণস্থলের আশেপাশের বায়ুর গুণমান নিরীক্ষণের জন্য সেন্সর ব্যবহার করে বাস্তব-সময়ের পর্যবেক্ষণ চালু করা হয়।
- আইন লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা: নির্মাণস্থলগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা না মানলে বা মান লঙ্ঘন করলে নির্মাতাদের উপর কঠোর জরিমানা আরোপ করা হয়।
৪. মৌসুমি নিষেধাজ্ঞা
- উচ্চ দূষণের সময় নির্মাণ নিষেধাজ্ঞা: শীতকালীন মাস বা উচ্চ বায়ু দূষণের দিনগুলিতে নির্মাণ কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হতো।
৫. নগর পরিকল্পনা এবং টেকসই নির্মাণ
- সবুজ ভবন নির্মাণ পদ্ধতি: পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে এমন সবুজ ভবন নকশা প্রমোট করা হয়েছিল এবং টেকসই নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়।
- প্রিফ্যাব্রিকেশন প্রযুক্তি: সাইটে নির্মাণ কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট ধুলো ও নির্গমন হ্রাস করতে প্রিফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং কম্পোনেন্টের ব্যবহার উৎসাহিত করা হয়।
আর ঢাকার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন ইট ভাটার উন্নয়ন:
ঢাকার আসেপাশের সব অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ করতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে সকল বৈধ ইট ভাটাতে পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে।
এরপর ধীরে ধীরে, রাজউক, আইএবি, আইইবি, রিহাব, এলজিইডিসহ নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে উপরের ৫ টা পয়েন্ট নিয়ে কাজ করতে হবে, এবং অননুমদিত ইট ভাটা থেকে ইট কেনা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
আরও খোঁজ নিন। শিখুন। কাজে লাগান। গবেষণা করুন। খুঁজে বের করুন। পলিসি বানান। এক সাথে কাজ করুন। তা না হলে একটা আস্ত জেনারেশন সারা জীবন অ্যাজমা আর খুকখুকানি কাশি নিয়ে বেঁচে থাকবে।
নতুন এক স্টাডি বলছে বায়ু দূষণ মানুষের বুদ্ধি কমিয়ে দেয়। টের পান ঢাকার দিকে তাকালে?