বাঙালি মুসলমানের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও দ্বন্দ্ব

Muktijuddho, Liberation War, Bengali Muslim

লাট সাহেবদের করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে থেকেই হিন্দু জমিদারেরা বাঙালি মুসলমানদেরকে সবচেয়ে নীচু জাত হিসেবে চিহ্নিত করে উঠতে বসতে অত্যাচার করেছে। রাজনীতি-ফাজনিতি-সংস্কৃতি পরে, মুসলমান কৃষকের নিজেদের জমি ও ধানের স্বাধীনতাই ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মূল চালিকা-শক্তি ছিল। আর বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের পেছনেও ছিল সেই জমিদারেরাই। তাই বাংলা ভাগ করা এবং জোড়া দেওয়ার মূলে হচ্ছে জমি ও ধানের অধিকার। বাংলা ভেঙে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরও মূল চাবিকাঠি সেই একই, মুসলমান কৃষকের নিজেদের জমি ও ধানের স্বাধীনতা, সেই সাথে মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি চর্চা করার অধিকার।

কিন্তু পূর্ব বঙ্গের বাঙালি মুসলমানেরা দেখলো, সাতচল্লিশে পাকিস্তান হওয়ার পরেও তারা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে পড়ে রইলো। তারা আগে জমিদারদের মাইর খেতো, এখন পশ্চিম পাকিস্তানের দাসত্ব করতে হয়। সেই সাথে তারা নাকি ‘ভালো মানের মুসলমান’ নয়। তাদের বাংলা ভাষা দিয়ে নাকি ঠিকমতো ইবাদত বন্দেগি হয় না। তারা শুধু তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক নয়, তারা ধর্মীয় দিক থেকেও দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমান হয়ে রইলো। পশ্চিমের পদলেহনকারী, নতজানু, হীনম্মন্য মুসলমান। আর বাঙালি মুসলমান যে পশ্চিমের জাতগুলোর চেয়ে নীচু শ্রেণীর মুসলমান, সেই চিন্তাটা তাদের মনের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো।

মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা—পূর্ব বাংলার সব ধর্মের মানুষের জন্যই অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু মাত্র রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল না, বরং এটা বাঙালি মুসলমানেরও এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্জন। একাত্তরে এসে এই প্রথমবার বাঙালি মুসলমান মাথা তুলে, কারও সামনে নতজানু না হয়ে, সগৌরবে, নিজ ভাষায়, নিজ স্বাধীনতায় ধর্ম পালন করতে পারলো—মুক্তিযুদ্ধের এই ধর্মীয় অর্জনটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। অদ্ভুতভাবে মুক্তিযুদ্ধের এই পয়েন্টটা সব আলোচনা থেকে মিসিং; সেকুলার এবং ধর্মীয় দুই আলোচনা থেকেই মিসিং (অথবা অনেকে হয়ত লিখেছেন, বলেছেন, আমার জনা নাই)।

দেখেন, আল্লাহ যে সব প্রাথমিক সামাজিক সিস্টেম কোরানের মাধ্যমে এসটাবলিশ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এক জাতির উপরে আরেক জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং কর্তৃত্ব বাতিল করা। রেসিজমকে নিষিদ্ধ করা। জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি দিয়ে কেউ কারোর ওপরে বা নিচে নয়। আরবরা, পাকিরা, ফর্সিরা, আফঘানিরা, মুঘলরা, বাঙালির চেয়ে উন্নত মুসলমান না। এটা আল্লাহই বলে দিয়েছেন কোরানে, ভীষণ স্পষ্টভাবে, জোর দিয়ে।

বখতিয়ার খিলজি থেকে গুনলে, সাড়ে সাতশ বছরের গোলামিপন্থি লেজুড়বৃত্তিক ধর্ম পালন থেকে মুক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধই বাঙালি মুসলমানকে নিজের মত করে মুসলমান হওয়ার প্রথম সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু কোন এক অবাক কারণে, ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধ একটা অস্বস্তিকর ডিসজাংশনের মধ্যে পড়ে আছে। কেউ কাউকে ধারণ করে না। কেন? স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারেরা বেশিরভাগ মুসলমান ছিল বলে? আরে ভাই, মুক্তিযোদ্ধাদেরও তো বেশিরভাগ মুসলমানই ছিল! এবং তারা যে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিল তার মধ্যে ধর্ম পালনের স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল!

কিন্তু বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর, দেশের মুসলমানদের একটা অংশ গোলামিপন্থি লেজুড়বৃত্তিক ধর্ম পালন থেকে বের হতে পারলো না, এখনো পারেনি! এখনো তাদের ধারণা, উর্দু, ফারসি, আরবি বলনেওয়ালারা বেটার মুসলমান। শুধু মাত্র জাতের কারণে পাকিস্তানি, আফগানি, আরবি লোকদেরকে এখনো উন্নততর মুসলমান হিসেবে ধরে নিয়ে চলেছে! জাতি-বৈষম্য-বিরোধী কোরানের স্পষ্ট নির্দেশ তারা মেনে নিতে পারে না। এবং শুধু মাত্র এই কারণে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এখনো! তাদের ধারণা, দুই পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়াতে তাদের ‘বেটার মুসলমান’ হওয়ার পথ, উন্নত জাতের মুসলমানদের পদলেহন চর্চার সহজ পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

আরে নিমক হারাম, বাঙালি মুসলমান হিসেবে নিজ দেশে সম্মানের সাথে ধর্ম পালনের অধিকার তোদেরকে কে দিয়েছে?—মুক্তিযুদ্ধ দিয়েছে। একাত্তরের আগে পাকিরা বাঙালিকে নীচু পদের মুসলমান বানিয়ে রেখেছিল, মনে নাই? বাঙালি মুসলমানদের ইসলামি কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে বসতে দেয়নি, মনে নাই? বাঙালি মুসলমানদের হিন্দুয়ানী বলে অবজ্ঞা করেছে চিরকাল, মনে পড়ে? শুধু মাত্র নীচু জাতের মুসলমান, নীচু জাতের মানুষ, এদেরকে মেরে ফেলা জায়েজ—এই মন্ত্র পড়িয়েই পাক বাহিনীকে দিয়ে তিরিশ লাখ মানুষ নির্বিচারে মেরে ফেলতে পেরেছিল, মনে নাই?

মুক্তিযুদ্ধই বাঙালি মুসলমানের মুক্তির সবচেয়ে বড় ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধই আপনাদেরকে বড় বড় হুজুর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তা না হলে আজও পাঠানদের ঠাপানি খেয়ে উর্দুতে শেরেকি গজল মুখস্থ করতেন সবাই। বাংলাদেশি মুসলমান হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতেন না কোনোদিন। তাই জামাতের পাকিপনা রাজাকারি গোলামির ফাঁদে পা দিবেন না। সেই পথ, কোরানের প্রাথমিক কনসেপ্টের বিরোধী; সেই পথ জাতিগত দাসত্ব এবং ধ্বংসের পথ।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments