ইতিহাস লেখা, পড়া, এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার অভ্যাস আমাদের তেমন নাই। কয়েক বছর আগের ঘটনাই আমরা চট করে ভুলে যাই। কিন্তু আওয়ামী শাসনের শুরু আর শেষ এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রেক্ষিত এবং ফলাফল যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে বিরাট বিপদ।
২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামিলীগের নির্বাচনী ইশতেহারের বড় অংশ জুড়ে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যার পরিপ্রেক্ষিত রাজাকার-অরাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ। যা স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরেও একটি জাতীয় নির্বাচনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল। তাই আপনারা যারা ২০২৪ এসে ভাবছেন এই আলোচনা তামাদি ও অপ্রাসঙ্গিক, যেমন জামাতে আমির বলছেন সব ভুলে গিয়ে আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই, তখন আরেকটু বেশি করে ভেবে নেবেন। কারণ ২০০৮ এর নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছিল। মিলিটারি এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ভোটার তালিকা ঠিকঠাক করা হয়েছিল, এবং এই নির্বাচন একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল।
তার মানে হলো, এই মাত্র ১৬ বছর আগেও দেশের ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনাকে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক মনে করে আওয়ামি লীগের রাজাকার বিরোধী ইশতেহারকে সমর্থন দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ভোট দিয়ে এসেছিল। খুব খেয়াল করে মনে রাখতে হবে এই কথা। রাজাকার-অরাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের আলোচনা এই দেশ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন প্রসঙ্গিকই থাকবে। যতই চুদুরবুদুর করেন, আর ভুজুং বুঝান না কেন, জনগণ এই প্রসঙ্গ ছাড়বে না। এটাই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের একমাত্র প্রসঙ্গ।
ইদানিংকালের রাজাকারি জয় গানকে জুলাই আন্দোলনের অ্যান্থেম হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। আপনাদের যদি মনে হয়, জুলাই পরবর্তী দেশের আপামর জনসাধারণের চেতনা হচ্ছে রাজাকার তোষণ—তাহলে আপনারা বেকুবের স্বর্গে বাস করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং জুলাই আন্দোলনের নেতা হোতারা যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ এবং রাজাকার-অরাজাকার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার না করেন তাহলে জুলাই আন্দোলনের ফল জামাত-শিবির নিয়ে যাবে। এবং জুলাই আন্দোলন জনসমর্থন হারাবে।
মনে রাখতে হবে, রাজাকারি লেজ জনগণের ভোটে নির্বাচনের রায়েই কাটা পড়বে। এর সাথে আওয়ামী লীগের ফেরত আসা, ভোটে অংশ নেওয়া, পালিয়ে যাওয়া, জয় পরাজয় জড়িত নয়। রাজাকার-অরাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ জড়িত। বৃহত্তর জনগণের পক্ষ একটাই, বাংলাদেশের পক্ষ একটাই, আর তা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ—তা আপনি যে দলেরই ভোট করেন, যেই মার্কা নিয়েই করেন না কেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না থাকলে ভোট পাবেন না। রাজাকারি চলবে না এই দেশে।
সেই সাথে মানুষের টুঁটি চিপাচিপি আর “শক্ত হাতে দমনের” ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। বাক স্বাধীনতা সর্বজনীন। রাজাকারের সন্তানও বাংলাদেশের নাগরিক, এবং তাদেরও বাক স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যে যা বলতে চায়, বলতে দিতে হবে। কেউ পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইতে চাইলে গাইবে, আপনার ভালো না লাগলে আপনি শুনবেন না, আপনি দ্বিগুণ পরিমাণ সোনার বাংলা গাইবেন। কেউ বঙ্গবন্ধুর পূজা করতে চাইলে তাকে পূজা করতে দিতে হবে। কেউ গোলাম আজমকে গুরু মানতে চাইলে মানতে দিতে হবে। কিন্তু রাজাকারি চেতনা, খাম্বা চেতনা, আওয়ামী চেতনা—এর কোনোটাই চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। কারো মুখেই কুলুপ মারা যাবে না। আপনার চেতনা, আপনার ধর্ম, আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ অন্যের গলায় ঠুঁসিয়ে দেওয়া চলবে না। আদর্শ এবং মতের অমিলকে শুধুমাত্র মতামত দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে, ধরপাকড়, দমন-নিপীড়ন করে নয়।
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কেন হস্তক্ষেপ চলবে না তা বুঝতে হলে এই গত জুলাই মাসের আন্দোলনের দিকে তাকাতে হবে। ভাবছেন আন্দোলনে জিতেই আপনার নতুন চাপিয়ে দেওয়া রাজাকারি ন্যারেটিভ জনগণ আসমানি বাণী হিসেবে মেনে নিবে? নিবে না। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনাকেও গদি থেকে টুপ করে ফেলে দিবে—ঠিক একই ভাবে, যেভাবে আওয়ামী লীগকে তাড়ানো হয়েছে।
তাই দুইটা কথা মনে রাখবেন, দুইটা ঘটনা মনে রাখবেন, ২০০৮ এর ডিসেম্বর আর ২০২৪ এর জুলাই। একটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গল্প আরেকটা বাক স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার অধিকারের গল্প। এই দুই জায়গায় যদি হাত দেন তাহলে টিকতে পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে হবে, মুক্ত চিন্তা, কথা বলা এবং ভোটের অধিকার রক্ষা করতে হবে। তা না হলে জুলাই ফিরে ফিরে আসবে।