আমার এক থাই বন্ধু অনেক দিন থেকেই ঢাকা যাবো, বাংলাদেশ দেখবো আলাপ আলোচনা করছে। সে বিশিষ্ট খাদোক। আমার কাছে অনেক গল্প শুনেছে মাছের ঝোল, ভর্তা, ভাজি, ডাল, সবজির ঝোল, বড়ি, শুঁটকি আর বিভিন্ন তরকারির। সেই থেকে বাংলাদেশে গিয়ে বাঙালি খাবার খাওয়ার স্বপ্নে বিভর।
তার চিরাচরিত প্রশ্ন, ঢাকায় বাংলা খাবারের দোকান কোথায় ভালো?
বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে এই প্রশ্ন আমি প্রায়ই শুনে থাকি, এবং এর উত্তর দিতে গিয়ে আমাকে লজ্জায় পড়তে হয়। কারণ সারা দেশে বাংলা খাবারের ভালো রেস্তোরাঁর প্রচন্ড অভাব।
দেশি খাবার বলে পথে ঘাটের রেস্তোরাঁগুলো যা বেচে তার কোনটাই দেশি না। বেশিরভাগটাই মোগলাই অপভ্রংশ, অথবা বাংলা রান্নার মোগলাইকরণ। যেমন, তারা কাবাব, গ্রিল, নান এগুলো করে, কোনটাই বাঙালি খাবার না। সবজি বলতে শুধু মিক্সড ভেজিটেবল নামক এক অখাদ্য পাওয়া যায়। এই সবজিতে কোন সবজির স্বাদ আলাদাভাবে পাওয়া যায় না। আর আছে মোরগ পোলাও, নানা পদের তোহারি আর বিরিয়ানি। বাঙালি রান্না তাহলে কোথায়? নাই আসলে।
বাঙালি রান্নার বানিজ্যিকীকরণ সেভাবে হয়নি। রেস্তোরাঁতে বাংলা খাবারকে মেইনস্ট্রিম ব্যবসায় আনার উপযোগী করে তেমন কেউ পরিকল্পিতভাবে আয়োজন করেনি। আমরা বাসা বাড়িতে যে খাবার খাই তা রেস্তোরাঁয় পাওয়া খুব কঠিন। ঢাকায় ভালো বাঙালি খাবার পাওয়া যায় এরকম রেঁস্তোরার সংখ্যা একদম হাতে গুনে ফেলা যায়।
আমার থাই বন্ধুকে এই ব্যাপারটা বোঝানো কষ্ট। কারণ থাইরা বাসায় যা খায়, ঠিক সেটাই পথে-ঘাটে, রেস্তোরাঁতে কিনতে পাওয়া যায়। মেনু এবং রান্নার ধরণে বাসা আর দোকানের তেমন কোন পার্থক্য নাই, শুধু আঞ্চলিক পার্থক্য আছে। তাই বাঙলি খাবার ঢাকায় যে কিনে খাওয়া যায় না সহজে—এই ব্যাপারটা তার কাছে অকল্পনীয়।
অনেকে বলেন বাংলা খাবার কেউ পয়সা দিয়ে রেস্তোরাঁয় খাবে না। সম্পূর্ণ ভুল। ভালো বাংলা খাবার ঠিকমত রাঁধতে পারলে শুধু বাঙালি কেন, সারা দুনিয়ার মানুষ চেটেপুটে খাবে।
বনানীর পাতুরি রেস্তোঁরা তার প্রমাণ। দেশি বিদেশি মানুষে ঠাঁসা থাকে যায়গাটা প্রায়ই। তারা দামে কিন্তু কম না। ৪-৫ পদের ভাত তরকারি জনপ্রতি ৳১,০০০-১,২০০ টাকা মত আসবে। বাঙালি খাবারের পরিপাটি “ফাইন ডাইন” আয়োজন। খাবারের তালিকা ও মান নিপাট বাঙালি, কোন ভেজাল নাই। তার মানে বাঙালি খাবার ঠিকমত রাঁধতে পারলে মানুষ প্রতি বেলায় হাজার টাকা খরচ করে কব্জি ডুবিয় খাবে।
আর আছে যাত্রা বিরতি। তরুণদের প্রিয় যায়গা। পুরদস্তুর বাঙালি নিরামিষ খাবার। অনেকগুলো কারণে যাত্রা বিরতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, প্রথমত বাঙালি খাবার মানুষ পয়সা দিয়ে খাবে না এই কথা যে ভুল তার প্রমাণ, দ্বিতীয়ত, পয়সা দিয়ে মানুষ যে নিরামিষ, ঘাস-লতা-পাতা খাবে না সেইটা ভুল প্রমাণ করেছে যাত্রা বিরতি। ভালো পরিবেশে রাঁধতে পারলে মানুষ ডাল-ভাত, সবজি সব খায়।