ভুল গাছ, বা ক্ষতিকর গাছ বলে কিছু আছে কি? জি, আছে। ভুল যায়গায় ভুল গাছ মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। হয়েছেও।
অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা রমনা পার্কের “ভুল” এবং ক্ষতিকর গাছের একটি তালিকা ও মানচিত্র তৈরি করে সেই গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমন কিছু গাছ যেগুলো রমনার প্রচীন ও দেশীয় জীববৈচিত্রের জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছিল। গাছ বিষয়ক উনার প্রজ্ঞার ব্যাপ্তি নিয়ে কারোর কোন সন্দেহ থাকার কথা না। উনি যদি গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত থেকে নির্দিষ্ট গাছ কেটে দেশীয় জীববৈচিত্র রক্ষার উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, ধরে নিতে হবে উনি জেনে বুঝেই সঠিক গাছগাছালি সঠিক যায়গায় রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তা করেছেন।
রমনায় তাঁর উদ্যোগে গাছ কাটা শুরু হলো। ওমনি আগ-পিছ উদ্দেশ্যে-বিধেয় কিছু না জেনে না বুঝে সাংবাদিকগণ ও উৎসাহী জনতা এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেন। কিছুদূর এগিয়ে কাজটা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এর মধ্যে যেটুকু করা সম্ভব হয়েছিল তার মধ্যে ছিল, বটমূলের চারপেশের মিলিটারি স্টাইলে বোনা কুৎসিৎ অপাংতেয় বিদেশি গাছের সারি কেটে ফেলে সেখানে একটা গোল যায়গা রেখে চারপাশে এমন কিছু দেশি গাছের সারি লাগানো হলো যাতে করে বৈশাখে যেন যায়গাটি চারপাশ থেকে সাদা আর বেগুনি ফুলে ভর্তি হয়ে থাকে।
উনি পুরো রমনা পার্কের রং ও গন্ধের একটা মানচিত্র কল্পনা করেছিলেন, দেশি গাছ যেগুলো দেশি পাখি ও পোকামাকড়ের জন্য সহায়ক এমন গাছ রেখে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন গাছ বুনে সারা বছর পার্কটি যেন রঙিন ও সুগদ্ধে ভরা থাকে তার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিছু কাজ হয়েছে, বেশিরভাগ অংশই করা সম্ভব হয়নি। ২০১৭ তে অধ্যাপক শর্মা চলেই গেলেন আমাদের ছেড়ে।
এই গল্পের কারণ হচ্ছে, অনেকেই গাছ কাটাকে জায়েজ করার অনেক গল্প দিবে, সেগুলোর উদ্দেশ্য সাবধানে খতিয়ে দেখতে হবে। যেমন সাত মসজিদ সড়কে গাছ কাটাকে দক্ষিনের নগর সভা যে মোড়কে মুড়িয়েই বেচার চেষ্টা করুক না কেন তাদের উদ্দেশ্য একটাই, জনগনের টাকায় অপ্রয়জনীয়, ব্যয়বহুল, জনবিচ্ছিন্ন প্রকল্প তৈরি করে পয়সা লুটপাট করা; এর আর কোন শুভ উদ্দেশ্য ও পরিণাম নাই।
কেন অপ্রয়জনীয়: সাত মসজিদ সড়কে রাস্তা বিভাজক তো ছিলোই! গাছগাছালিতে ভরা খুব সুন্দর বিভাজক ছিল। নতুন করে তৈরি করা সম্পূর্ণ অপ্রয়জনীয় ছিল। বিভিন্ন মোড়ের ডানে-বামে ঘোরা ও পারাপার বন্ধ করার আপত উদ্দেশ্য যানবাহনের চাপ কমানো মনে হতে পারে। কিন্তু তার পক্ষে কোন গবেষণা, তথ্য, সিমুলেশন করা হয়েছিল? কোন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল? (গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা কিন্তু সরকারের কাছেই আছে, ডিটিসিএকে জিজ্ঞেস করলেই তারা বলতে পারতো কোন মোড়ের কোন রাস্তা খোলা বা বন্ধ করার ফল কী হতে পারে। তাদের সিমুলেশন সফটওয়ার আছে, গবেষক আছে)।
কেন ব্যয়বহুল ও জনবিচ্ছিন্ন: কংক্রিট কেন? ফেয়ারফেস কংক্রিট সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্মাণ সামগ্রীর একটা। রাস্তা বিভাজক কেন ঢালাই করে কংক্রিটে বানাতে হবে? কংক্রিটের বিভাজক কয়েকটা ইংগিত দেয়, চুরির টাকার পরিমাণ বাড়ানো, অহংকার, দম্ভ আর জনবিচ্ছিন্ন আচরণ। কংক্রিট ঢালতে পারলেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে, ব্যয় যত বাড়বে তত ফুর্তি। কংক্রিটের বিভাজক দাম্ভিক কারণ, কংক্রিটের বিভাজক ভাঙ্গা কঠিন, তারা কিভাবে এত নিশ্চিত হলেন যে এই নকশাই সঠিক নকশা? জনবিচ্ছিন্ন কারণ, উঁচু কংক্রিটের বিভাজক হেঁটে রাস্তা পারার বিরোধী আয়োজন। এখন সারা বিশ্বের সকল সভ্য শহরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে হাঁটাপথ এবং জনগনের হাঁটার স্বাচ্ছন্দ। ঢাকায় উল্টা। নগরসভা চায় আমরা সবাই গাড়িতে বসে জ্যাম উপভোগ করি, হাঁটে তো শুধু ভুখা, নাঙ্গা গরীবেরা।